চায়ের সবুজ পাতায় মিশে আছে শ্রমিকদের নিঃশব্দ স্বপ্ন
মানসী সাহা
প্রকাশিত হয়েছে : ০৯ নভেম্বর ২০২৫, ১:৫৪ অপরাহ্ণ
সবুজ চা বাগানের সৌন্দর্যের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক নিরব যন্ত্রণা—হাজারো নারী শ্রমিকের ঘাম, অভাব আর অদৃশ্য সংগ্রামের গল্প। হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার পাঁচটি চা বাগানে প্রায় ৩০ হাজার মানুষের বসবাস। এদের অর্ধেকই নারী—যারা ভোরের কুয়াশা ফুঁড়ে, শিশিরভেজা পাতায় হাত বাড়িয়ে জীবন যুদ্ধ শুরু করেন প্রতিদিন। কিন্তু এই হাড়ভাঙা পরিশ্রমও তাদের জীবনে আনতে পারেনি সামান্য সচ্ছলতা, সামান্য মর্যাদাও নয়।
কৈশোর পেরোনোর আগেই শুরু হয় তাদের কর্মজীবন। হাতে বই নয়, থাকে চা পাতার ঝুড়ি। শিক্ষা, স্বাস্থ্য বা বিশ্রামের মতো মৌলিক অধিকারের স্বপ্ন দেখা যেন তাদের জন্য বিলাসিতা। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নিরলস পরিশ্রমের পর হাতে আসে এমন সামান্য মজুরি—যা দিয়ে তিনবেলা খাবার জোটানোই কঠিন।
নোয়াপাড়া চা বাগানের শ্রমিক শেফালী রেলির কণ্ঠে ক্ষোভ আর ক্লান্তির ছোঁয়া, “আমাদের জীবনে নেই কোনো নিশ্চয়তা। বাগানে ছোট্ট চিকিৎসাকেন্দ্র আছে, কিন্তু সেখানে ওষুধ নেই, ডাক্তারও ঠিকমতো আসে না। গর্ভবতী মেয়েরাও ছুটি পায় না, পেটের সন্তান নিয়েই মাঠে কাজ করতে হয়।”
বৈকুন্ঠপুর চা বাগানের বিমলা চৌহান বলেন, “আমাদের দিন শুরু হয় ভোর চারটায়। ঘরের কাজ শেষ করে সকাল আটটার মধ্যেই মাঠে যেতে হয়। রোদে পুড়ি, বৃষ্টিতে ভিজি, তবুও থামি না। কাজ না করলে চুলায় আগুন জ্বলে না।”
দিন শেষে তারা ফেরেন ক্লান্ত শরীরে, কিন্তু বিশ্রাম তাদের ভাগ্যে নেই। মাথায় ঘাস, লাকড়ি বা পানির কলসি নিয়ে বাগানের আঁকাবাঁকা পথে হাঁটেন ঘরে ফেরার সময়ও। ঘরে ফিরে আবার রান্না, কাপড় ধোয়া, সন্তানদের দেখাশোনা। পরদিন সূর্য ওঠার আগেই শুরু হয় একই ঘূর্ণি—জীবনের অন্তহীন পুনরাবৃত্তি।
জগদীশপুর বাগানের কমলা সাঁওতাল বলেন,“আমরা দেশের চা উৎপাদনে বড় অবদান রাখি, কিন্তু কেউ আমাদের কথা ভাবে না। শিক্ষা নেই, প্রশিক্ষণ নেই, উন্নতির সুযোগও নেই। আমাদের জীবন যেন শুধু পরিশ্রমের জন্যই।”
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নৃপেন পাল মনে করেন, এই নারীরা কেবল শ্রমিক নন, তাঁরা দেশের অর্থনীতির প্রাণ।
“চা বাগানের নারী শ্রমিকদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা, মাতৃত্বকালীন ছুটি ও পুষ্টির ব্যবস্থা নিশ্চিত করা জরুরি। একই সঙ্গে নারী শিক্ষার প্রসার ও বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে হবে,” বলেন তিনি।
সরকারি কর্মকর্তা মো. জাহিদ বিন কাশেম, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, জানান,“চা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে সরকার বিভিন্ন সহায়তা দিচ্ছে—নগদ অর্থ, গবাদি পশু, হাঁসমুরগি, টিউবওয়েল ইত্যাদি। আগের তুলনায় তাদের অবস্থা কিছুটা উন্নত হয়েছে।”
তবু বাস্তবতা রয়ে গেছে কঠিন। চা বাগানের এই নারীরা দিনের পর দিন, প্রজন্মের পর প্রজন্ম, এক অবহেলিত জীবনের বোঝা বয়ে চলেছেন। তারা দেশের অর্থনীতির চাকা ঘোরান, অথচ নিজের জীবনে ঘুরে না উন্নতির চাকা।
সবুজ পাতায় জমে থাকা শিশিরের মতোই নরম ও নিঃশব্দ তাদের স্বপ্ন—একদিন হয়তো তারা-ও পাবেন ন্যায্য মজুরি, শিক্ষা, বিশ্রাম আর সম্মানের জীবন।





