হবিগঞ্জের বড় ডাস্টবিন খোয়াই নদী
হবিগঞ্জ প্রতিনিধি :
প্রকাশিত হয়েছে : ২০ নভেম্বর ২০২৫, ৬:৪৩ অপরাহ্ণ
নদীকে কেন্দ্র করে যে জীবন ব্যবস্থা, সভ্যতার কথা বলা হয় তা এখানে সম্পূর্ণই অনুপস্থিত। কারণ এখানে নদী বিধ্বংসী কার্যক্রম করা হয়। নদীর বুকে ময়লা ফেলে ভাগাড় করা হয়, দখল করা হয়, নদীর বুকে স্থাপনা তৈরি করা হয়। আক্ষেপের সুরে এ কথাগুলোই বলেন, খোয়াই নদী খনন ও তীর থেকে ময়লা-আবর্জনা অপসারণের দাবিতে নৌ-যাত্রা কর্মসূচির বক্তারা। বুধবার দুপুরে এ কর্মসূচির আয়োজন করে খোয়াই রিভার ওয়াটারকিপার। কর্মসূচিতে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লোকজন অংশ নেন। তারা নৌকায় করে নদীর বিভিন্ন অংশ ঘুরে দেখেন।
এ সময় বক্তারা বলেন, ‘এক সময়ের খরস্রোতা খোয়াই নদীর গভীরতা কমে যাওয়ায় যাত্রী ও পণ্য পরিবহনসহ নদীকেন্দ্রিক জীবন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। নদীকে এখন বৃহৎ ডাস্টবিন হিসেবে রূপান্তর করা হয়েছে। খোয়াই মুখ এলাকায় বহু বছর ধরে নদী ও তীরে ময়লা আবর্জনা ফেলে নদীর অনেকাংশ ভরাট করে ফেলা হয়েছে। যা থেকে চরম দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। ওই এলাকা দিয়ে জেলার তিনটি উপজেলায় যোগাযোগ রয়েছে। চরম দুর্গন্ধ ও স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে মানুষকে চলাচল করতে হচ্ছে।
হবিগঞ্জ প্রেস ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অ্যাডভোকেট মনসুর উদ্দিন আহমেদ ইকবাল বলেন, ‘জেলার কৃষি, ব্যবসা- বাণিজ্য, যাত্রী, পণ্য পরিবহনে অন্যতম মাধ্যম ছিল খোয়াই। এমনকি পাশের জেলার মানুষজনও নদীটি ব্যবহার করতেন। বড় বড় নৌকা চলাচল করতো। কৃষি কাজের অন্যতম মাধ্যম ছিল এই নদী। খনন ও যত্নশীল আচরণ না করায় এর নাব্যতা কমে গেছে। এখন অনেক জায়গায় পায়ে হেঁটেও পার হওয়া যায়। মাঝি ফারুক মিয়া বলেন, ‘আমাদের নৌকা ঘাটটি ছিল পার্শ্ববর্তী গরুবাজার এলাকায়। এক যুগ আগেও সেখানে শত শত যাত্রী ও পণ্যবাহী নৌকা দেখা যেতো। এখন সেগুলো ইতিহাস।’
দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে খোয়াইসহ হবিগঞ্জের সংকটাপন্ন নদীগুলোর দখল ও দূষণের বিরুদ্ধে কাজ করছেন খোয়াই রিভার ওয়াটারকিপার তোফাজ্জল সোহেল।
তিনি বলেন, ‘সরকার আসেন, সরকার যায়, প্রশাসক আসেন, প্রশাসন যান—কিন্তু খোয়াই নদীর অবস্থার কোনো উন্নতি নেই। দীর্ঘদিন ধরে দখল ও দূষণ অব্যাহত থাকায় নদীটিকে আর নদী বলার উপায় নেই। পুরাতন খোয়াই নদী পরিণত হয়েছে ড্রেন বা নালায়। শহরের ময়লা আবর্জনার ভাগাড় হলো খোয়াই নদী। এছাড়া নদীর মূল অংশ থেকে নির্বিচারে বালু ও মাটি উত্তোলনের কারণে নদীটি মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়েছে। অবস্থা দেখে মনে হবে এ নদীটি অভিভাবকহীন।’
নদী পরিবেশ দেখভাল করার জন্য অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। নদীর প্রতি উদাসীনতা ও দূরদর্শিতার অভাব কিংবা অন্য যেকোনো কারণেই হোক সংকট দিনের পর দিন ধরে চরমে পৌঁছেছে। নদীতে এখন স্বাভাবিক নৌ চলাচল নেই। নদীকে ময়লা আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত করা হয়েছে।
গবেষকরা বলছেন, নদীর মাছের শরীর থেকে প্লাস্টিক পাওয়া গেছে। যা ভবিষ্যতের জন্য মারাত্মক আতঙ্কের বিষয়। যে পরিবেশ ও মানবিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে, সেটি থেকে উত্তরণের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে ভবিষ্যতে আরও মারাত্মক অবস্থার সৃষ্টি হবে।
ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) এর সংগঠক ও সিলেট মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির উপাচার্য (ভিসি) প্রফেসর ড. মোহাম্মদ জহিরুল হক বলেন, ‘দীর্ঘদিনের অনাচার, অবহেলা ও বর্বরতার শিকার খোয়াই নদী। এটি হবিগঞ্জবাসীর জন্য আত্মহত্যার শামিল। খোয়াই নদীর সঙ্গে হবিগঞ্জের ইতিহাস, ঐতিহ্য এমনকি সভ্যতা জড়িত। এছাড়া এ নদীটি হাওর ব্যবস্থার অন্যতম অংশ। খোয়াই নদীতে ফেলা পলিথিন, প্লাস্টিক ও অপচনশীল বর্জ্য হাওরের তলদেশে জমা হচ্ছে। মেঘনা হয়ে এসব প্লাস্টিক বর্জ্য চলে যাচ্ছে বঙ্গোপসাগরে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সাম্প্রতিক গবেষণায় হবিগঞ্জের হাওরের মাছে প্লাস্টিক কণার অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। খোয়াই নদীর দূষণকে কেবল পরিবেশ বা প্রতিবেশগত দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার উপায় নেই। বরং তা জনস্বাস্থ্য ও জীব-বৈচিত্র্যের জন্যও মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আইনের প্রয়োগ, জনসচেতনতা ও জন প্রতিরোধ ছাড়া খোয়াই নদীর অবশিষ্টাংশ থাকবে না।’





