সিলেট-১ আসনে খোশ মেজাজে জামায়াত, শঙ্কা বিএনপিতে
লিমন তালুকদার
প্রকাশিত হয়েছে : ০৪ নভেম্বর ২০২৫, ৯:৩১ অপরাহ্ণ
সিলেটের ১৯ আসনে ১৪ জন প্রার্থীকে দল থেকে মনোনয়ন দিল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি। সোমবার (৩ নভেম্বর) বিকেলে রাজধানীর গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এর মধ্য দিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাটিয়ে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হলো। সিলেটের ১৪ টি আসনে তালিকা প্রকাশের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে সরব আলোচনা। দলীয় সিদ্বান্তকে অনেকেই স্বাগত জানালেও সমালোচনাও শুরু হয়েছে অনেক আসন নিয়ে। নিজেদের পছন্দের প্রার্থী না পেয়ে অনেক প্রার্থীর কর্মী ও সমর্থকরা নানারকম সমালোচনা করছেন। আবার অনেকেই দলীয় সিদ্বান্তের প্রতি অনুগত থেকে মনোনয়ন তালিকায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তবে বেশি সমালোচনা শুরু হয়েছে সিলেট-১, সিলেট-৩ আসন নিয়ে। সিলেট-৪ ও সিলেট-৫ আসনে কোনো প্রার্থীর নাম ঘোষণা করা হয়নি।
সিলেট-১ আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশি ছিলেন দলীয় দুই প্রার্থী। তাদের দুজনই দলীয় চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা। এর একজন হলেন খন্দকার আবদুল মুক্তাদির এবং অপরজন হলেন সিসিকের সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। দু’জনই সিলেট-১ আসনে নির্বাচনের লক্ষ্যে দীর্ঘদিন থেকে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন। বিশেষ করে সাবেক সিসিক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বেশ কয়েকবার শো’ডাউন দিয়ে নির্বাচনী প্রচারণাও শুরু করেছিলেন। সেসময় দলের গ্রিন সিগন্যালের কথাও উঠেছিল আরিফ অনুসারীদের মুখে। তবে খন্দকার মুক্তাদির দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার খবরে খোশ মেজাজে রয়েছে জামায়াত অনুসারীরা। তাদের মতে, বিএনপিতে আরিফুল হক প্রার্থী হলে সেখানে বিজয়ী হতে হলে জামায়াতকে অনেক বেগ পেতে হতো।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিলেট-১ আসন অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ আসন। দেশের রাজনীতিতে একটি প্রবাদ রয়েছে—সিলেট-১ আসন যার, সরকার তার। অর্থাৎ সিলেট-১ আসনে যে দল নির্বাচিত হবে, সেই দলই সরকার গঠন করবে। যে কারণে আসন্ন নির্বাচন ঘিরে এই আসনটি নিয়ে জল্পনা-কল্পনা চলছিল। এই আসনে আরিফুল হক চৌধুরী কয়েক দফায় আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেন। স্থানীয় পর্যায়ে সমর্থন জোগাড়েও তিনি ছিলেন বেশ সক্রিয়। তার ঘনিষ্ঠ নেতাকর্মীরা দীর্ঘদিন ধরেই দাবি করে আসছিলেন, নগরীর তৃণমূল বিএনপি ও সাধারণ ভোটারদের মধ্যে আরিফুলের গ্রহণযোগ্যতা সবচেয়ে বেশি।
তবে শেষ পর্যন্ত বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা খন্দকার আব্দুল মুক্তাদিরের ওপরই আস্থা রেখেছে দল। মুক্তাদির ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসন থেকে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন। তিনি ওই নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীকে অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের কাছে পরাজিত হন। এরপর গতবছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরে পাওয়ায় সিলেট-১ আসনে বিএনপির সুযোগ তৈরি হয়েছে। অন্যান্য রাজনৈতিক দলের প্রার্থীও এই আসনে থাকলেও বরাবরই মূল আলোচনায় থাকেন বিএনপি প্রার্থীরা। এজন্যই এই আসন নিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের দুই উপদেষ্টা খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির ও আরিফুল হক চৌধুরী সরব ছিলেন।
খন্দকার অবদুল মুক্তাদির
খন্দকার আবদুল মুক্তাদির ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী ছিলেন। দ্বাদশ নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ না করায় দলীয় সিদ্বান্ত অনুযায়ী তিনি নির্বাচন থেকে সড়ে দাঁড়ান। ত্রয়োদশ নির্বাচনেও এই আসন থেকে তিনি একজন শক্তিশালী প্রার্থী। খন্দকার আবদুল মুক্তাদিরের পিতা মরহুম খন্দকার আবদুল মালিক ছিলেন সিলেটে বিএনপি প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম। তিনি ১৯৭৯ সালের দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিলেট-৮ আসন থেকে, ১৯৯১ সালের পঞ্চম ও ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬ সালের ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিলেট-১ আসন থেকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পিতার পদাঙ্ক অনুসরন করে খন্দকার আবদুল মুক্তাদির সিলেটের উন্নয়ন করে সিলেটবাসীর আস্থা অর্জন করতে চান। আপাদমস্তক একজন ভদ্রলোক হিসেবে তিনি দলীয় নেতাকর্মীদের কাছে বেশ সুপরিচিত। সিলেটে বিএনপির গ্রুপ কেন্দ্রীক রাজনীতিতেও খন্দকার বলয় বেশ শক্ত অবস্থানে। তবে সবকিছুর পরও তৃণমূল মানুষের সাথে তিনি সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেন নি-এমন বিষয়টি প্রাধান্য পাচ্ছে ভোটারদের আলোচনায়। বিশেষ করে স্থানীয় বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে আরিফুল হক চৌধুরী যেভাবে সরব থেকে জনমত গড়ে তুলতে পারেন, সেখানে খন্দকার আবদুল মুক্তাদির অনেকটাই নির্ভার।
আরিফুল হক চৌধুরী
২০১৩ সালের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী মরহুম বদর উদ্দিন আহমদ কামরানকে পরাজিত করে প্রথম মেয়র হয়েছিলেন বিএনপি নেতা আরিফুল হক চৌধুরী। ২০১৮ সালের নির্বাচনে তিনি ফের দলীয় প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে মেয়র হন। তবে ২০২৩ সালের নির্বাচনে দলের বারণ থাকায় মেয়রপ্রার্থী হননি তিনি। ওই বছরের ২০ মে তিনি ঘোষণা দিয়ে সিটি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান। আরিফ প্রার্থী না হওয়ায় সিটি নির্বাচনে মেয়র হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। আরিফুল হক চৌধুরী দু’দফায় মেয়র নির্বাচিত হওয়ার আগে ছিলেন নির্বাচিত কাউন্সিলর। সিলেট পৌরসভার কাউন্সিলর দিয়ে তার ‘জনপ্রতিনিধি’র জীবন শুরু। এখনো তিনি সিলেট মহানগরীর অনেকটা অপরিহার্য জনপ্রতিনিধি। সিলেটের উন্নয়নের বরপুত্র মরহুম অর্থমন্ত্রী এম. সাইফুর রহমানের জামানায় তিনি ছিলেন সিলেটের সবচেয়ে ক্ষমতাধর লোক। নগরের কাঙ্খিত উন্নয়নে আরিফুল হক ছিলেন প্রধান পুরুষ। এখন তিনি মেয়রের পদে নেই। তবে প্রতি সপ্তাহে একবার হলেও তিনি উঠে আসেন আলোচনায়। ক্ষমতায় না থাকলেও সিলেটের গণ-মানুষকে নিয়ে যেকোন আন্দোলনে তিনি সরব ভূমিকা পালন করেন।সিলেটের সাবেক জেলা প্রশাসক তাড়াতে যে আরিফুল হক ছিলেন ব্যতিব্যস্ত, তিনিই আবার নতুন যোগ দেওয়া জেলা প্রশাসকের সাথে সিলেটের উন্নয়নে কাজ করছেন হাত মিলিয়ে। জেলা প্রশাসককে সাথে নিয়ে ব্যাটারি চালিত অটোরিক্সার বিরুদ্ধে মাঠে নামেন তিনি। মহানগরীতে অবৈধ ব্যাটারিচালিত রিকশার বিরুদ্ধে তার কার্যক্রম ইতোমধ্যেই নগরবাসীর দৃষ্টি কেড়েছে। নগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের সহায়তায় সুফলও পাচ্ছে নগরবাসী। এর পর পরই নামেন ফুটপাত মুক্ত করার অভিযানে। ‘সিলেট আন্দোলন’ নাম দিয়ে তিনি সিলেটের উন্নয়ন বৈষম্যের বিরুদ্ধে গড়ে তোলেন শক্ত প্রতিরোধ। বিক্ষোভ মিছিল থেকে অবশেষ অবস্থান কর্মসূচী পালন করেন। এই কর্মসূচীর মাধ্যমে গোটা সিলেট বাসীকে জাগিয়ে দেন তিনি। সিলেটের ৮ দফা যৌক্তিক দাবি নিয়ে তার এই আন্দোলন শুধু সিলেটে নয়, ছড়িয়ে পড়ে ঢাকাসহ সিলেটী অধ্যুষিত ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। মোট কথা নগর উন্নয়নে তাঁর আপোসহীন ভূমিকা সর্বমহলে প্রশংসার যোগ্য।
ভোটারদের অভিমত, সিলেট-১ আসনে জামায়াত প্রার্থীকে মোকাবেলা করতে হলে আরিফুল হকের বিকল্প নেই। দল যদি বিষয়টি পুনর্বিবেচনা না করে,তাহলে হয়তো ভরাডুবি হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। তাদের মতে. দুই যুগ থেকে সিলেটের মানুষের কাছে এক প্রিয় নাম আরিফুল হক চৌধুরী। যিনি উন্নয়নের শর্তে দল ও মতের উর্ধ্বে উঠে সকল প্রকার ঝুঁকি মোকাবেলা করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলা বিএনপির এক নেতা বলেন, আরিফুল হক দলীয় প্রতীক ছাড়াও নির্বাচনে অংশ নিলেও বিজয়ী হওয়া সম্ভাবনা বেশিই থাকবে। পরাজিত সহলেও তাঁর হারানোর কিছু থাকবে না। কারণ সিসিক নির্বাচনে এই প্রার্থীর সাথে মোকাবেলা করার সাহস কেউ দেখাতে পারবে না।
মীরাবাজারের ব্যবসায়ী আবুল কালাম বলেন, সিলেটের ম্যজিকম্যান হচ্ছে আরিফুল হক চৌধুরী। তাঁর মতে, নিজ দলের বাহিরেও সিলেটের সকল শ্রেণী পেশার মানুষ যাকে ভোট দিবে অনায়াসে-তিনি আরিফুল হক চৌধুরী। কারণ, সবার আগে সব সময় তিনি দল-মতের উর্ধ্বে থাকতে পারেন।
এ বিষয়ে সিলেট-১ আসনের বিএনপির মনোনীত প্রার্থী ও দলটির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির বলেন, ‘আমি দলের সিদ্ধান্ত নিয়েই আগে থেকে কাজ শুরু করেছি। আজ দল প্রার্থী ঘোষণা দিয়েছে। এজন্য দলের প্রতি কৃতজ্ঞ।’





