ময়লার ভাগাড়ে হবিগঞ্জে হারিয়ে যাচ্ছে শতবর্ষী দীঘি
হবিগঞ্জ প্রতিনিধি
প্রকাশিত হয়েছে : ০২ ডিসেম্বর ২০২৫, ৮:২৭ পূর্বাহ্ণ
হবিগঞ্জ শহরের শত বছরের পুরোনো দীঘি কালের বিবর্তনে ময়লার ভাগাড়ে হারিয়ে যাচ্ছে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে দীঘির পাড় দখল করে অবৈধ দোকান তৈরির প্রতিযোগিতা। একসময় যে দীঘিতে কোর্ট স্টেশন, মোহনপুর, সুলতান মাহমুদপুরসহ বিভিন্ন পাড়া-মহল্লার লোকদের একমাত্র স্বচ্ছ পানির নিরাপদ স্থান ছিল, এখন সেটি ময়লার ভাগাড় আর কচুরিপানার আশ্রয়স্থল হয়ে গেছে।
স্থানীয়রা বলছেন, দ্রুত যদি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার উদ্যোগ না নেওয়া হয় তা হলে অদূর ভবিষ্যতে এই দীঘির অস্তিত্ব থাকবে না। তারা আরও বলেন, নতুন বাসস্ট্যান্ড, মোতালেব চত্বরের চারপাশ, মোহনপুরের একাংশ, সুলতান মাহমুদপুরের একাংশের একমাত্র পানির উৎস হচ্ছে এই বিশাল দীঘি। কখনো যদি কোনো ধরনের অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে তা হলে এসব এলাকার বাসিন্দারা চরম বিপদে পড়বে।
আর পরিবেশবিদরা বলছেন, যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাব আর প্রভাবশালীদের দখলে চলে যাচ্ছে বিশাল এই দীঘিটি। দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
হবিগঞ্জ শহরের মোতালেব চত্বর এলাকায় লাখাই সড়ক ও বাইপাস সড়কের মধ্যভাগে অবস্থিত সাবেক সংসদ সদস্য এম এ মোতালেবের নামে পরিচিতি মোতালেবের দীঘি। তবে বর্তমানে এটি সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের অধীনে রয়েছে। এই দীঘির দুই পাশ ভরাট করে গড়ে উঠেছে অবৈধ দোকানপাট। রয়েছে টমটম অটোরিকশার স্ট্যান্ড। যেখান থেকে কতিপয় লোকজন নিয়মিত মাসোহারা আদায় করে থাকেন বলে জানা গেছে।
সরেজমিন দেখা যায়, প্রায় আড়াই একর জায়গাজুড়ে বিশাল এই দীঘির বুকে কচুরিপানা আর ঘাসে ভরে আছে। চারপাশে কৃষি বাজারসহ আশাপাশের সব ময়লা স্তূপ করে রাখা আছে। পুরো দীঘিজুড়ে কোথাও পানির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। অথচ একসময় স্বচ্ছ পানির নিরাপদ স্থান ছিল বলে জানান স্থানীয়রা।
মোহনপুর এলাকার প্রবীণ আব্দুল বাছিত ময়না জানান, আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন এই দীঘিতে দলবেঁধে সাঁতার কাটতাম। দীঘিটি আরও অনেক বড় ছিল। ধীরে ধীরে ময়লা আর মাটি ফেলে দীঘির আকার ছোট করা হয়েছে।
সুলতান মাহমুদপুর এলাকার ষাটোর্ধ্ব কালাম মিয়া জানান, এটি অনেক পুরাতন দীঘি। আগে আশপাশের এলাকা থেকে শত শত মানুষ এই দীঘিতে এসে গোসল করত, সাঁতার কাটত, অনেকে তার ছেলেমেয়েকে সাঁতার শেখাত। কয়েক বছরের ব্যবধানে দীঘি হারিয়ে ডোবায় পরিণত হয়েছে।
ওই এলাকার প্রবীণ নারী মুমিনা খাতুন জানান, একসময় ছেলেমেয়েকে সঙ্গে নিয়ে এই দীঘিতে গোসল করতাম। এত সুন্দর পানি ছিল যে ছেলেমেয়েদের তুলে নিয়ে আসতে পারতাম না। তারা সারাক্ষণ দীঘিতে সাঁতার কাটত। আজ সেই দীঘিতে পা ফেলার অবস্থা নেই।
সিলেট মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর ও পরিবেশবিদ অধ্যাপক ড. মো. জহিরুল হক শাকিল বলেন, হবিগঞ্জ একসময় পুকুর ও দীঘির শহর হিসেবে পরিচিত ছিল। এ ঐতিহ্য আমাদের মাধ্যমেই ম্লান হয়েছে। এভাবে আমরা ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের দিকে যাচ্ছি। যার পরিণতি হচ্ছে মানবিক বিপর্যয়। দেশব্যাপী জলাভূমি বিনষ্টের ও দখলে একটি প্রক্রিয়া হচ্ছে বর্জ্য ও কচুরিপানার মাধ্যমে তা মজা পুকুরে পরিণত করা। একসময় মাটি ভরাট করে পুরোপুরি জলাভূমিটির অবস্থার পরিবর্তন করে ঘোষণা দেয়া হয় এখানে কোনো সময় কোনো জলাভূমি ছিল না। আমরা সেটি টাউন মডেল স্কুলের সামনের পুকুরের বেলায় দেখেছি। মোতালেব দীঘিটি মূলত রেলের সম্পত্তি, পরবর্তী সময়ে তা সড়ক ও জনপথ বিভাগের কাছে চলে যায়, যা একটি সমবায় সমিতির নামে লিজ আনা হয়। একসময় সমিতির মাধ্যমে মাছ চাষ করা হতো। কিন্তু বর্তমানে এই দীঘিটি দেখে আমরা হতাশ।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সদস্য মো. বাহার উদ্দিন জানান, রক্ষণাবেক্ষণের অভাব আর প্রভাবশালীদের দখলে চলে যাচ্ছে বিশাল এই দীঘিটি। আগামীর প্রজন্মকে নির্মল পরিবেশে বাঁচাতে হলে এসব দীঘিকে রক্ষা করতে হবে।





