শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ০২:৪৭ অপরাহ্ন



Repoter Image

সিলেট আই নিউজ ::

প্রকাশ ২৭/০১/২০২২ ১০:২৬:২৬

হামিদা আব্বাসী: সেকেন্ড হলের বান্ধবীরা আমাদের হল এ আসত খাওয়ার জন্য, থাকার জন্য,অনেকেই ডাবলিং এ থাকত আমাদের সাথে,ওদের মা বোন বা মেয়ে অন্যান্য আত্নীয় আসলে দেখা যেত তাদের হল এ প্রবেশ করা নিষেধ তাই আমাদের সাথে কথা বলে আমাদের হল থাকার ব্যবস্থা করত। ওদের সাথে দেখা হলেই ওরা বলত- বান্ধবী প্রথম ছাত্রী হল এর তোরা ভালো আছিস, আমাদের হল এর ম্যাম কোনো সমস্যা নিয়ে গেলে অনেক দুর্ব্যবহার করেন, আমি বলতাম আমাদের হল এ ও অনেক সমস্যা আছে,বাট আমরা এসব ম্যামের সাথে আলোচনা করে সমাধানের চেষ্টা করি,তখন ওরা বলত আমরা তো আলোচনা করার সুযোগ ই পাইনা। 

১৩ তারিখ দ্বিতীয় ছাত্রী হল এর মেয়েরা হল এ সবাই একত্র হয়ে প্রভোস্ট ম্যামকে আলোচনার জন্য ডাকে,কিন্তু তিনি আসেন নি বরং দুর্ব্যবহার করেন, এমনকি উনার সহকারী কাউকেও পাঠাতে নারাজ। আর এর থেকেই হল এ শোরগোল শুরু হয়,আওয়াজ শোনে আমরা প্রথম ছাত্রী হল এর মেয়েরা ঘটনা কি জানার জন্য বের হই,জানতে পারি - তারা ম্যামকে আসতে বললে ম্যাম বলেন, " তোমাদের মধ্যে থেকে তো কেউ মরে নাই,মরলে বইল,আসবনে।" তখন মেয়েরা বলে ম্যাম আপনি না আসলে আমরা হল থেকে বের হয়ে যাবো- উত্তরে ম্যাম বলেন- "তোমাদের যদি লজ্জা-শরম থাকে তাহলে হল থেকে বের হয়ে যাও,আর হল এ আইসো না,তোমরা থাকলে থাকো না থাকলে আমার এত ঠ্যাকা নাই।" 

মেয়েরা ম্যামের ব্যবহারে রাগে- দুঃখে ভিসি স্যারের কাছে যান, তিন ঘণ্টা যাওয়ার পর ভিসি স্যার আসেন এবং মেয়েদের কাছে লিখিত অভিযোগ চান,মেয়েরা রাত হয়ে যাওয়ায় হল এ ফিরে আসে। 

প্রভোস্ট ম্যামের দুর্ব্যবহার ও বিভিন্ন হয়রানির কারণে মেয়েরা প্রভোস্ট ম্যামের পদত্যাগ দাবি করে তিন দফা দাবি ভিসি স্যার বরাবর প্রেরণ করে, কিন্তু স্যার দাবিগুলো মানতে চাননি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে দ্বিতীয় ছাত্রী হল এর মেয়েরা গোলচত্বরে সমবেত হয়ে স্লোগান দিতে থাকে তিন দফা দাবি নিয়ে। [ উল্লেখ্য : তখন শুধু দ্বিতীয় হল এর মেয়েরাই আন্দোলনে ছিল] 

তাদের স্লোগান আর আন্দোলনের মধ্যেখানে সন্ধ্যার পরপরই প্রশাসনে দায়িত্বরত স্যারদের সামনে কয়েকজন ছেলে মেয়েদের আন্দোলন বানচাল করার জন্য হামলা করে, [ কেউ কেউ বলে ওরা সাবেক ছাত্রলীগের নেতাকর্মী ছিল,আর কেউ কেউ বলল ওরা প্রশাসন থেকে টাকা নিয়ে এটা করছে,এর পেছনে কে ছিল আমি এখনো নিশ্চিত নই] 

মেয়েদের ছোট শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে যখন হামলা হল,তাও প্রশাসনে থাকা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বশীল স্যারদের সামনে এর প্রতিবাদে পরেরদিন আমরা প্রথম ছাত্রী হল এর মেয়েরা ওদের সাথে একাত্মতা পোষণ করে আন্দোলনে শরিক হই। পরক্ষণে দেখি আমাদের সাথে কয়েকজন ভাইয়েরাও একাত্মতা পোষণ করে এবং তারা প্রতিবাদ জানায়। আন্দোলনের পরিসর বৃদ্ধি হওয়ায় আনুমানিক তিনটার দিকে স্যাররা আসেন এবং বলেন তোমাদের পূর্বের সমস্যা সমাধান হবে, প্রভোস্ট ম্যামের পদত্যাগ নিয়ে কিছু না বলায় মেয়েরা মানেনি। না, না শ্লোগান দিয়ে স্যারদের পেছনে পেছনে যাচ্ছিল। হঠাৎ দেখা যাচ্ছিল স্যাররা ভিসি স্যারের সাথে মিলিত হয়ে আইআইসিটি বিল্ডিং এর দিকে যাচ্ছেন,মেয়েরাও ভিসি স্যারকে বলার জন্য স্যারদের অনুসরণ করে যাচ্ছিল,স্যাররা এবং আন্দোলনরতরা কাছাকাছি হওয়ায় জায়গার সংকুলানের অভাবে কিছুটা ধাক্কাধাক্কি  শুরু হয়, তখন একটু যাওয়ার জায়গা বের করে ভিসি স্যারকে নিয়ে স্যাররা আইআইসিটি বিল্ডিং এ ঢুকে যান এবং তৎক্ষণাৎ স্যাররা আইআইসিটির প্রধান গেট তালা দেন, তখন মেয়েরা জড়ো হয়ে স্লোগান দিতে থাকে, স্লোগান দেওয়া অবস্থায়ই তখন বাহির থেকে কয়েকজন শিক্ষক ভিসি স্যারের সাথে দেখা করতে চাইলে মেয়েরা বাহিরে গেইটে তালা দেয়,ফলে স্যাররা আর ঢুকতে পারেন নি।

প্রায় চল্লিশ মিনিট পর দেখা গেল দলবেঁধে পুলিশ আসা শুরু করেছে,প্রাথমিকভাবে পুলিশদের দেখে অনেক মেয়েরাই ভয় পেয়ে যায়, [ যদিও আমি ভিড়ের মধ্যে ছিলাম না,তবে ক'জন বের হয়ে আসলে জানতে পারি তারা ভয় পেয়ে মূল অবস্থান থেকে সরে এসেছে ] তখন সংহতি প্রকাশ করা ভাইরা মেয়েদের আড়াল করে মানবশেকল হয়ে দাড়ায়, এবং সবার হাতে ফুল দেওয়া হয়।সবাই ফুল নিয়ে শ্লোগান তুলে - ফুল নিয়ে পুলিশকে ক্যাম্পাস ছাড়ার আহ্বান জানানো হয়। এরমধ্যে একবার একজন স্যার বলেন তোমরা ভিসি স্যারের পথ ছেড়ে দাও,আলোচনা করে তোমাদের দাবি মানা যায় কিনা আমি দেখবো, স্যারের কথায় মানা যায় কিনা শব্দগুলো থাকায় মেয়েরা ভরসা না পেয়ে শ্লোগান আরো জোড়ালো করে। 

আমি সেখান থেকে সরে গোলচত্বরের দিকে পা বাড়াই,তখন মুক্তমঞ্চের সামনের মাঠে দেখি অনেক ভাই,বন্ধু,জুনিয়র রা দাড়িয়ে আছে, ব্যাপারটা কেমন লাগছিল তাই ভিসি স্যার এবং মুক্তমঞ্চের কাছের দুই অবস্থানের মধ্যেখানে ঘটনা কি ঘটতে যাচ্ছে জানার চেষ্টা করি, এর মধ্যেই জানতে পারি মুক্তমঞ্চে অবস্থিত তারা সবাই ছাত্রলীগের নেতাকর্মী, অবশ্য তাদের অনেককেই আমি চিনি। কতক্ষণ পরে মুক্তমঞ্চের মিটিং থেকে আসা আমার ঘনিষ্ঠ ক'জন বন্ধু, সিনিয়র ভাই,এবং জুনিয়র কে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম -- তারা আসলে ভিসি স্যারের পথরুদ্ধ করে থাকা মেয়েদের সরিয়ে ভিসি স্যারকে রুম থেকে আনবে কিনা এ দ্বিধাদ্বন্দে আছে,সিংহভাগ ই চায় না মেয়েদের গায়ে হাত তোলার। পরক্ষণে দেখলাম ছাত্রলীগের অনেক নেতাকর্মী হঠাৎ হেঁটে হেঁটে এক কিলোর দিকে আসতেছে, আমরা ভয় পেয়ে কিছুটা সরে গিয়ে রেজিস্ট্রার বিল্ডিং সংলগ্ন রাস্তার দিকে পা বাড়াই,এবং একটি গাছের আড়াল করে দাড়াই। দেখতে দেখতে দেখলাম যে তারা আইআইসিটি বিল্ডিং এর দিকে আসেনি, আইআইসিটি বিল্ডিং এর রাস্তা পেরিয়ে গেছে।তখন কিছুটা শঙ্কামুক্ত হই, এবং সামনের দিকে আইআইসিটি বিল্ডিং এর পুকুর পাড়ে আমরা কজন মিলে আন্দোলন বিষয়ক কথা বলি [ উল্লেখ্য যাদের সাথে কথা বলছিলাম ওদের মধ্য পাঁচজন ছিল যারা ছাত্রলীগের বিভিন্ন পদে আছে ] ওদের সাথে কথা বলে কিছুটা ভয় চলে যায়,তাই কি হয় এটা জানার জন্য থাকি আরো কিছুক্ষণ সেখানে। মাগরিবের আযান হওয়ায় নামাজ পড়ার জন্য আরেকটু সামনে আসি,সাথে থাকা বান্ধবী বলল যে এ অবস্থা রেখে রুমে যাওয়া ভাল্লাগেনা, এর মধ্যেই আরেকজন বলে রুমে যাবি নাকি থাকবি, এরমধ্যেই হঠাৎ গুলির আওয়াজ হয়, গুলির আওয়াজ হতেই আমরা আন্দোলন স্পটে তাকাই এবং রেজিস্ট্রার বিল্ডিং এর দিকে এগিয়ে যাই। মিনিটখানেক পর একটানা পর পর এত আওয়াজ হয় যে সবাই প্রথম ছাত্রী হলের দিকে দৌড়ে আসে, যেহেতু আমি কিছুটা দূরে ছিলাম তাই দৌড়ে রুমে এসে জানালার ফাঁক দিয়ে ঘটনা কি ঘটতেছে প্রত্যক্ষ করলাম চারিদিক অন্ধকার বিভৎস অবস্থা।  একের পর এক সাউন্ড গ্রেনেন্ডের আওয়াজে বুকের ধকধকানিতে কখন স্তব্ধ হয়ে বসে ছিলাম টের ই পাইনি। ঘন্টাখানিক পর বুঝতে পারলাম আজকে মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে ফিরেছি। ইতোমধ্যেই চেনা অচেনা অনেকেই আহত দেখতে পাইলাম, লাইভ দেখে। ফোন দিয়ে অনেকের খবর নিলাম তারা কেমন আছে, কেউই তখন ভালো ছিলনা। 

আরো কিছুক্ষণ পর অনলাইনে গিয়ে দেখি ভিসি স্যার সময় টিভিতে লাইভে এসে তৎক্ষনাৎ কিছু কথা মিথ্যা বলতেছেন এবং  বললেন ক্যাম্পাস অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে, সবাই যেন ১২ টার আগে হল ছাড়ে,  আর ক্যাম্পাসে ১৪৪ দ্বারা জারি করা হয়েছে। 

আমি এতে অনেক ভয় পাই এবং ব্যাগ গুছানোর উদ্যোগ নেই সকালে ঘুম থেকে উঠে বাড়িতে চলে যাওয়ার জন্য। 

কিন্তু ঘুমাতে পারিনি,হঠাৎ কেন এমনটা হল, আমরা কি এমনটা হতে চাইছি। তারপর আবার অনলাইনে গেলাম দেখতে পেলাম শাবিপ্রবির হাজার হাজার শিক্ষার্থী মুক্তমঞ্চে জড়ো হয়েছে, এবং ভিসির পদত্যাগ চেয়ে আন্দোলন করার শ্লোগান তুলেছে।

আমার মনে প্রশ্ন জাগল এ ঘটনায় ভিসি স্যারের পদত্যাগ চাইবো কেন! কজন কে প্রশ্ন করলে তারা বলল একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে বিশেষ করে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে একমাত্র পুলিশ আনার এবং পুলিশকে দিয়ে গুলি করার হুকুম একমাত্র ভিসি স্যারই দিতে পারেন,যেহেতু এ বিষয়টা আমি আগে জানতাম না তাই পরে - একজন ভিসি স্যারের প্রশাসনিক ক্ষমতাকাঠামো এবং দায়িত্ব কর্তব্য নিয়ে পড়াশোনা করে অবগত হই, আমাদের ক্যাম্পাসের এ অমানবিক হামলার জন্য ভিসি স্যারের হুকুম রয়েছে। এ কথা শুনে তখন আমার অনেক কষ্ট অনুভূত হয়।  রাগ হয় স্যার কেমন করে পারলেন আমাদের ওপর হামলা করাতে। পরেরদিন আর বাড়িতে যাই নি। ভাবলাম যৌক্তিক আন্দোলনে সামনে না থাকতে পারি পেছনে থেকে একটা শ্লোগান দিয়ে হলেও সাথে থাকি। এ মনোভাব পোষণ করেই অনেকেই আন্দোলনের জন্য বিভিন্ন ভয়,হুমকি, দ্বিধাদ্বন্দে কে উপেক্ষা করে থেকে যায়। আর এভাবেই শাবিপ্রবিতে ভিসির পদত্যাগ চাই আন্দোলন শুরু হয়।

লেখক: শিক্ষার্থী, শাবিপ্রবি

সিলেট আই নিউজ / এমএনআই

মাই ওয়েব বিট

আপনার ওয়েবসাইটের ভিজিটর মনিটরিং করার জন্য এটা ব্যবহার করতে পারেন, এটি গুগল এনালাইটিক এর মত কাজ করে।

ফেসবুক পেইজ