

পংকজ কান্তি গোপ টিটু
প্রকাশ ২০২২-০৫-২৪ ০৮:৪৭:১৫

কেন নজরুল ? -এই শিরোনামটি চমক সৃষ্টি কিংবা পাঠক আকৃষ্ট করার জন্যে নয় | এত কবি-সাহিত্যিকদের ভিড়ে আজো কেন কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের কাছে এতো প্রত্যাশিত, এতো প্রয়োজনীয় ; তা প্রমাণের নিমিত্তেই এই শিরোনাম | মাত্র ২৩ বছরের সৃষ্টিশীল জীবন তাঁর : ১৯১৯-১৯৪২ | কিন্তু সেই স্বল্প সময়ের মধ্যেই তিনি কতো রূপে আত্মপ্রকাশ করেছেন ! একাধারে কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, গায়ক, বাদক, সংগীতজ্ঞ, সংগীত পরিচালক, সাংবাদিক, সম্পাদক, পত্রিকা-পরিচালক, অভিনেতা, চলচ্চিত্র কাহিনীকার, চলচ্চিত্র পরিচালক | প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি অগণন মানুষের হৃদয় স্পর্শ করেছেন | কবির জন্মের ১২৩ বছর পরে, স্তব্দতার ৮০ বছর পরে, মৃত্যুর ৪৬ বছর পরেও কি, নজরুলকে একটি দিনের জন্যেও আমাদের যাপিত জীবন থেকে আড়াল করতে পেরেছি ? তিনি তো প্রতিটি মূহুর্তে উনার সৃষ্টিকর্মের দ্বারা উপস্থিত ও জাগ্রত | তাঁর জনপ্রিয়তা আজো ক্রমবর্ধমান | আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় যেমন তাঁর সৃষ্টি এক জ্বলন্ত প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল, তেমনি আমাদের প্রাত্যহিক জীবনেও তিনি প্রয়োজনীয় উপাচারে পরিনত হয়েছেন | সঙ্কটে-নজরুল, দারিদ্রে-নজরুল, তারুণ্যে-নজরুল, দ্রোহে-নজরুল, প্রেমে-নজরুল, মিলনে-নজরুল; নজরুল নেই কোথায় ? জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের সাথে তিনি ঘনিষ্ট হয়ে আছেন | তাইতো কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের এতো কাঙ্খিত |
শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে প্রতিকুলতার সাথে সংগ্রাম করে যারা বিশ্ববন্দিত হয়েছেন, কাজী নজরুল ইসলাম তাদের মাঝে অন্যতম | উত্তরাধিকার সূত্রে কিংবা অনুকুল পরিবেশের বদান্যতায় নয়, কাজী নজরুল ইসলাম নায়কের আসনে আসীন হয়েছেন আপন মেধার জোড়ে | দরিদ্রতা, বৈরী পরিবেশ তাঁকে রুখতে পারেনি | তিনি বিশ্বাস করতেন ধর্ম, শাস্ত্র, মন্দির, মসজিদের চেয়েও পবিত্র মানুষ | মানুষকে ভালোবাসেন বলেই পরাধীন জাতির স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেন |
সামাজিক অবিচার, বৈষম্য, ধর্মীয় গোড়ামি, সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে তিনি তাঁর কবিতায়, গানে যে বক্তব্য রেখেছেন, আজো তা মানুষকে অনুপ্রাণিত করে | আমাদের যাপিত জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে 'নজরুল জীবন-দর্শন' অবশ্য অনুসরণীয় | স্বল্প পরিসরে এর স্বপক্ষে কিছুটা আলোকপাত করা হলো -
অভাব-অনটন কিংবা সংকটময় মুহূর্তে আমরা প্রায়ই ধৈর্য হারিয়ে ফেলি | অথচ এই দরিদ্রতাকে নজরুল বরণ করেছিলেন বন্ধু, শুভার্থী হিসেবে | অর্থ সঙ্কট ছিল নজরুলের নিত্যসঙ্গী | অথচ দারিদ্রের কাছে তিনি হার মানেন নি | তিনি বলেছেন,
'হে দারিদ্র তুমি মোরে করেছ মহান
তুমি মোরে দানিয়াছ খৃষ্টের সম্মান
কণ্টক মুকুট শোভা দিয়াছ তাপস
অসংকোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস |'
জাগতিক জীবনে প্রেম-ভালোবাসা মানব-মানবীকে আরো রঙ্গীন করে তুলে | আধুনিককালে প্রেমকে কামে রূপান্তরেই যেন স্বার্থকথা | অথচ নজরুল প্রেমকে শ্বাশ্বত, সুন্দর হিসেবেই উপস্থাপন করেছেন | তিনি লিখেছেন-
'হে মোর রাণী তোমার কাছে হার মানি
আজ শেষে
আমার বিজয় কেতন লুটায় তোমার
চরণ তলে এসে |'
আজ যে নারী স্বাধীনতার কথা এতো ঘটা করে বলা হচ্ছে, নজরুল কিন্তু বহু বছর আগেই আমাদের সে পথের সন্ধান দিয়ে গেছেন | তাঁর অনুসৃত পথেই আজো হাটছি আমরা | তিনি বলেছেন,
'বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর |'
এমন সাহসী উক্তি নজরুল ছাড়া এমন করে কে আর বলেছেন আমাদের ? বাঙালির সমগ্র সংস্কৃতিকে রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আর একজনই সবচেয়ে ব্যাপক ও গভীর ভাবে প্রভাবিত করেছেন - তিনি কাজী নজরুল ইসলাম | বাঙালি হিন্দু-মুসলমানকে নজরুল ছাড়া আর কে এমন ভাবে মিলাতে চেয়েছেন ? বাঙালি মুসলমানের মন ও মননকে নজরুল ছাড়া আর কোন কবি এতো আপন করে বুঝতে পারেননি |ঈদের আনন্দই যেন ফিকে হয়ে যায় 'ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশির ঈদ'- গানটি না গাওয়া হলে | নজরুলের ভজন, কীর্তন, শ্যামা বন্দনা আমাদের মনকে যেভাবে ছুঁঁয়ে যায়,আর কোনো কবির সৃষ্টি এমনটি করে কিনা সন্দেহ ! মনে পড়ে ছাত্রাবস্থায় রামকৃষ্ণ মিশন, হবিগঞ্জ- এ থাকতাম | তখন নিয়মিতই মিশনে কাজী নজরুল ইসলামের মাতৃসঙ্গীতগুলো গাওয়া হতো |
শোনা যায়, নজরুলের গানের সংখ্যা রবীন্দ্রনাথের চেয়েও বেশী | পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত কোনো একজন কবি এতো বেশি গান রচনা করেননি | কথাটি অসম্ভব নয় কারণ- শেষের দিকে নজরুল গ্রামোফোন কোম্পানির ফরমাসে যান্ত্রিক নিপুণতায় অজস্র গান উৎপাদন করে যাচ্ছিলেন | প্রেমের গান, কালীর গান, ইসলামী গান, হাসির গান ; সব রকম | সে সব গানের সবগুলোই এখনো গ্রন্থাকারে সংগৃহিত হয়নি | তাই তাদের অস্থিত্বের কথাও আমরা অনেকে জানি না |
কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর গানে, কবিতায়, সকল সৃষ্টিতে তারুণ্যের বন্দনা করেছেন | তাঁর কাজে আমরা গতি পাই | সামনে এগিয়ে যাবার প্রেরণা পাই | নোংরা, পচা, বাসীকে দুরে ঠেলে সুন্দরকে প্রতিষ্ঠাই তো নজরুলের স্বার্থকতা | চির নতুন এ কবি সময়ের চেয়েও আধুনিক | তিনি অবলীলায় প্রচুর বিদেশি শব্দ বিশেষ করে- আরবি, ফারসি ও উর্দ্দু শব্দ আমাদের সাহিত্যে ঢুকিয়েছেন | তাঁর কল্যাণে প্রায় তিন হাজার বিদেশী শব্দ, আজ আমাদের হয়ে গেছে |
আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃত যদি রূপ-রস-গন্ধে ভরে উঠে তার অনেকটাই জুড়ে আছেন নজরুল | নজরুল সাহিত্যের বাকী অংশ বাদ দিলেও কেবল 'বিদ্রোহী' কবিতার জন্যেই তিনি বেঁচে থাকবেন যুগ-যুগ ধরে | বিদ্রোহী'র এমন রূপ এর আগে আর আমরা দেখিনি | কাজী নজরুল ইসলাম তার গান, কবিতা রচনায় সব সময়ই থেকেছেন সাধারণ মানুষের পাশাপাশি | মানুষের অধিকার, দুঃখ-কষ্ট, আনন্দ-বেদনা উঠে এসেছে পরম মমতায় | শিশুকাল, যৌবনকাল ও বৃদ্ধকাল | মানবজীবনের এ তিন কালেই আমরা কাজী নজরুল ইসলামকে খুঁজে পাই | বালকবেলার প্রত্যুষে আমাদের ঘুম ভাঙ্গে 'ভোর হলো দোর খোলো, খুকুমনি ওঠরে' দিয়ে ;
তেমনি যৌবনে আমাদের চেতনাকে শানিত করে 'বল বীর, বল উন্নত মম শির' | আর জীবন সায়াহ্নে গেয়ে উঠি-
'খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে বিরাট শিশু আনমনে' কিংবা
'চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়,
আজিকে যে রাজাধিরাজ কা'ল সে ভিক্ষা চায় |'
আজ যখন দেখি আমরা 'নজরুল -সাহিত্যে'র সঞ্জীবণী রস গ্রহণ না করে, ধার করা বিদেশি সংস্কৃতিকে নিজের করে ভাবি : তখন বিস্মিত ও লজ্জিত হই | এ লজ্জা আমাদের সকলের | এখনই সময় বাঙালির ঘরে ঘরে নজরুলকে নিয়ে যাবার | আর যেন কোনোদিন শিশু-কিশোরের মুখ থেকে প্রশ্ন শুনতে না হয়- 'কেন নজরুল ?'
গ্রন্থঋণ:
১) নজরুল ইসলাম : নানা প্রসঙ্গ -মুস্তফা নূর উল ইসলাম
২) নজরুল স্মৃতি : বিশ্বনাথ দে
৩) শ্রেষ্ঠ নজরুল : আব্দুল মান্নান সৈয়দ
৪) অন্তরঙ্গ অনিরুদ্ধ : কল্যাণী কাজী
৫) চিরবিদ্রোহী : মো: সিরাজ হক
লেখক:
সংস্কৃতি কর্মী ও সহকারী শিক্ষক,
পুটিজুরী শরৎ চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়,
বাহুবল, হবিগঞ্জ
আইনিউজ/এসএম

ফেসবুক মন্তব্য