আই নিউজ ডেস্ক ::
প্রকাশ ১১/০৮/২০২২ ১৮:৫২:০৫
চিত্রঃ ইবনে বতুতা(রঃ)
আবু আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ ইবনে বতুতা ও শাহজালাল
মধ্যযুগের বিখ্যাত পর্যটক আবু আব্দুল্লাহ মোঃ ইবনে বতুতা পূর্ববঙ্গের প্রথম স্বাধীন সুলতান ফখরউদ্দিন মুবারক শাহ আল ফখরার রাজত্বকালে (৭৩৯ হিঃ-৭৫০হিঃ) জালাল উদ্দিন নামক একজন বিখ্যাত দরবেশের সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে ৭৪৫ হিজরি সনে কামরূপের পার্বত্য অঞ্চল পরিভ্রমণ করেন এবং তখন তিনি সেখানে এই মহান দরবেশের সাক্ষাৎ লাভ করেন। শাহজালাল(রঃ) সিলেটে আগমনের প্রায় বিয়াল্লিশ বছর পর ইবনে বতুতার সহিত তাঁর দেখা হয়। ইবনে বতুতার ভ্রমণকাহিনি হতে তৎকালীন বাংলার যে রাজনৈতিক বিবরণ পাওয়া যায় তাতে অনুমিত হয় সিলেট বিজয়কালে ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে শামসউদ্দিন ফিরোজের যে বলবনি বংশ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিল, তারা ১৩৪৫ খ্রিস্টাব্দে ক্ষমতায় ছিলনা এবং বাংলার শাসন ক্ষমতা তখন অন্যদের হাতে চলে যায়। দিল্লির সম্রাট গিয়াস উদ্দিন বলবনের পুত্র বাঙ্গালার সুলতান নাসির উদ্দিন বগরা খান তৎপুত্র সুলতান শামস উদ্দিন ফিরোজ শাহ দেহলবির বংশের শেষদিকের সুলতানদের দুর্বলতার সুযোগে আলী শাহ লাকনৌতির (পশ্চিমবাংলা) অধিপতি হয়ে যান। বাঙ্গালার পূর্বাঞ্চলীয় সোনারগাওয়ের শাসনকর্তা ফখরউদ্দিন আল ফখরা যখন দেখলেন তাঁর প্রভু বলবনি বংশধরগণের হাত হতে রাজত্ব অন্যরা কেড়ে নিয়েছে তখন তিনি সোনারগায়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করে নিজেকে পূর্ববঙ্গের স্বাধীন সুলতান ঘোষণা করেন। বলবনি যুগের বিশাল বাঙ্গালা রাজ্য পূর্ব ও পশ্চিম দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। সোনারগাওয়ের ফখর উদ্দিন ও লাকনৌতির আলী শাহ পুরো বাঙ্গালা নিজ অধিকারে নিতে পরস্পর যুদ্ধে লিপ্ত হন। আলী শাহ দিল্লিপতি মোহাম্মদ বিন তুঘলকের অধীনতার ভান করে ফখর উদ্দিনকে ভারত সম্রাটেরও বিদ্রোহীতে পরিণত করেন।
শাহজালাল(রঃ) সম্পর্কে বিশ্বাসযোগ্য বিবরণ একমাত্র ইবনে বতুতার ভ্রমণকাহিনি হতে অবগত হওয়া যায়। ইবনে বতুতা ভারত সম্রাট মোহাম্মদ বিন তুঘলকের দুত হিসাবে জাহাজে চড়ে চীন গমনকালে ১৩৪৫ খ্রিস্টাব্দের শীতকালে সুপ্রসিদ্ধ দরবেশ শাহজালালের সহিত দেখা করার জন্য সমুদ্রতীরবর্তী বাঙ্গালার সাদকাওয়ান (চট্টগ্রাম) বন্দরে অবতরণ করেন। ঐতিহাসিক ব্লকম্যান অসংখ্য যুক্তি প্রমাণ দ্বারা এই সাদকাওয়ানকে চট্টগ্রাম বন্দর বলে নির্ণয় করেছেন। ইবনে বতুতার মতে পূর্ববঙ্গ তখন শিক্ষিত ও জনদরদি সুলতান ফখরউদ্দিনের (উপাধি মুবারক শাহ) নেতৃত্বে স্বাধীন ছিল ও দিল্লি অধিপতি মোহাম্মদ বিন তুঘলকের অধীনতা স্বীকার করত না। মোহাম্মদ বিন তুঘলকের দূত ইবনে বতুতা তাই এই বিদ্রোহী সুলতানের সহিত সোনারগাঁ গিয়ে দেখা না করে স্থলপথে চট্টগ্রাম হতে হেঁটে হেঁটে সোজা শ্রীহট্টে রওয়ানা হন।
ইবনে বতুতা শীঘ্রই শাহজালালের আধ্যাত্মিক অলৌকিক ক্ষমতার পরিচয় পেয়ে অবাক হয়ে যান। চট্টগ্রাম হতে শ্রীহট্টের দুরত্ব প্রায় ২২৫ মাইল। সাদকাওয়ান (চট্টগ্রাম) হতে অনবরত একমাস হেঁটে তিনি কামরূপের পাহাড় অঞ্চলে পৌছেন। তখনকার দিনে আজকালকার মত তেমন উন্নত সড়ক ব্যবস্থা ছিলনা। প্রতিদিন গড়ে ৮ কিংবা ১০ মাইল করে অগ্রসর হলে ২৫/৩০ দিনে পৌঁছানোর কথা। শ্রীহট্ট পৌছিতে যখন আর দুই দিন বাকী আছে তখন ইবনে বতুতা দেখলেন, শাহজালালের চারজন শিষ্য তাঁর অনুসন্ধান করছে। শাহজালাল তাঁদেরকে ডেকে বলে দেন, পশ্চিম দেশ হতে একজন ভ্রমণকারী আসতেছেন, তাঁকে অমুক স্থানে গিয়ে অভ্যর্থনা করে সসম্মানে নিয়ে এসো।
ইবনে বতুতার ভাষ্য- অগন্তুকদের মুখে একথা শুনে সত্যি আশ্চর্য্য হলাম, যার সাথে জীবনে কোনদিন দেখা হয় নাই তিনি কেমন করে আমার আগমনবার্তা জানতে পারলেন। নিশ্চয়ই কোন দিব্যজ্ঞান সম্পন্ন ওলিআল্লাহ ছাড়া এমন কাজ হতে পারে না। আমার মনে হল ঐ ব্যক্তি বর্তমান যুগের একজন শ্রেষ্ট ওলি আউলিয়া ছাড়া কেউ নন। ইবনে বতুতা লিখেছেন, ফলে দরবেশকে দেখার আগ্রহ আমার ভীষণভাবে বেড়ে গেল ও আমি তাঁদের সাথে শেখকে দেখতে সিলেট অভিমুখে রওয়ানা হলাম।
একটি গোহার বাহিরে তাঁর খানকায় উপনীত হলাম। তাঁর খানকার নিকট আর কোন বাড়িঘর নেই। অনেক হিন্দু মুসলমান শেখকে দেখতে আসত এবং প্রচুর খাদ্য দ্রব্যাদি উপহার দিত। খানকার ফকির ও অতিথিদের তাঁতেই স্বাচ্ছন্ধে চলে যেত। শেখের নিজের সম্পদের মধ্যে ছিল শুধু একটি গাভী। প্রত্যেক দশ দিন রোজা রাখতেন এবং নিজ গাভীর দুধ খেয়ে রোজা ভাঙ্গতেন। এই সময় তিনি অতিশয় বৃদ্ধ ছিলেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত কৃশ ও লম্বা আবয়ব বিশিষ্ট সুপুরুষ। মুখে গোঁফদাড়ি অল্পই ছিল। তিনি সারা রাত্রি নামাজ পড়তেন।
তাঁর নিকট সে অঞ্চলের অধিবাসীগণ ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন। তিনি চল্লিশ বৎসর ধরে অনবরত রোজা পালন করছিলেন। ভারতবর্ষের প্রধান ওলিগণের মধ্যে তাঁকে গণনা করা হয়। ইবনে বতুতার ভাষ্য- “আমি সম্মুখে যাওয়া মাত্রই তিনি উঠে আমাকে আলিঙ্গন করলেন। আমার দেশ ও ভ্রমণ সম্মন্ধে অনেক কিছু জিজ্ঞাসা করেন ও আমি উত্তর দিলাম। শেখের আস্থানায় তিনদিন অবস্থানের পর বিদায়ের দিন দেখতে পাই শেখের পরিধানে একটি শালের চাপকান। আমি মনে মনে চিন্তা করলাম শেখ যদি পোষাকটি আমাকে দিতেন, তবে ভারি খুশী হই। শেখ নিজে একটি সাততালি দেওয়া পোষাক পরে শালের চাপকানটি সত্যই আমাকে দান করে দিলেন। খানকার বাহির এলে তাঁর শিষ্যরা আমাকে বলল- শেখ বলেছেন, আমি এই পোষাকটি চাইে, আর তিনি তা দিবেন। কিন্তু পোষাকটি প্রকৃতপক্ষে শেখের বন্ধু চীনদেশে ইসলাম প্রচারকারী বুরহান উদ্দিন সাগরজীর জন্য তৈরি। এই পোষাকটি চীনদেশের এক বিধর্মী রাজা যথাসময়ে আমার নিকট থেকে নিয়ে যাবে এবং বুরহান উদ্দিন সাগরজিকে উপহার দিবে। আমি শেখের সঙ্গীগণকে বললাম, শেখের আশির্বাদ এই পবিত্র পোষাক, তিনি নিজ হাতে তা আমাকে পরিয়ে দিয়েছেন। আমি এই পবিত্র পোষাক পরে কোন রাজার নিকট যাবনা। আমি এই পোষাক কাউকেও দিবনা, তিনি রাজা হউন আর যে-ই হউন।”
ইবনে বতুতার বিবরণ- “আমি শেখকে ছেড়ে আসার এগার মাস পর চীনের খানসা নগরে উপস্থিত হই। এই ফারজা গাঁয়ে দিয়ে পথে হাঁটছিলাম। ঘটনাচক্রে সেখানকার উজিরের সঙ্গে আমার দেখা হল। তিনি আমাকে রাজপ্রসাদে নিয়ে যান। রাজা আমাকে মুসলিম বাদশাহদের সম্পর্কে নানা প্রশ্ন করেন ও আমার গায়ের ফরজাটির ভুয়সী প্রশংসা করেন। অতঃপর উজির আমাকে তা খুলে ফেলতে বললেন। আমার বাঁধা দেবার কোন উপায়ই ছিলনা। বিনিময়ে আমাকে দশটি পোষাক, কতকটি ঘোড়া ও প্রচুর ভ্রমণ ব্যয় প্রদান করেন। আমি খুব দুঃখানুভব করি ও শেখের ভবিষ্যতবানী ফলে যেতে দেখে যারপরনাই বিষ্মিত হই।
কিছুদিন পর চীনের খানবালিক বা পিকিং শহরে শেখ বুরহানউদ্দিন সাগরজির খানকায় উপস্থিত হই। তখন লক্ষ্য করি বুরহান উদ্দিন সাগরজি উক্ত পোষাকটি পরে কোরান তেলাওত করছেন। আমি এই ফরজাটি সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, এই ফরজা আমার বন্ধু জালাল উদ্দিন আমার জন্য তৈরি করেছিলেন। ফারজাটি সরাসরি আমার নিকট পৌছা কঠিন ছিল বিধায়, যে কোন ব্যক্তির মারফতে তা আমার নিকট পৌছবে। ফারজাটি কিভাবে আমার নিকট পৌছবে তাও তিনি একটি চিঠির মাধ্যমে পূর্বেই আমাকে অবগত করেছিলেন।
একথা বলে চিঠিখানা তিনি আমাকে পড়তে দেন। চিঠিখানা পড়ে আমি বিষ্ময়ে হতবাক হয়ে পড়ি। চিঠিতে স্পষ্ট করে লিখা ইবনে বতুতা ভারত সফরকালে আমার সহিত সাক্ষাৎ করবেন, ফারজাটি তার মাধ্যমে প্রেরণ করব। পথিমধ্যে খানসার রাজা ফারজাটি ছিনিয়ে নিয়ে আপনার হাতে পৌছে দিবেন ও ইবনে বতুতার সাথে আপনার সাক্ষাৎ হবে। চিটিখানা পড়ে হজরত শাহজালালের প্রতি আমার হৃদয়ের ভক্তি ও ভাবের গভীরতা আর বেড়ে যায় ও আবার তাঁর সাথে সাক্ষাতের ইচ্ছে ব্যক্ত করি। কিন্তু সেই মুহুর্তে বুরহান উদ্দিন সাগরজি আমাকে জানান যে, তাঁর বন্ধু জালাল উদ্দিনের পৃথিবীর আধ্যাত্মিক শৃংখলার উপর আধিপত্য ছিল এবং কিছুদিন হয় তাঁর ইন্তেকাল হয়েছে।
তিনি আরও বললেন, জালাল উদ্দিন প্রাত্যহিক ফজরের নামাজ কাবাগৃহে পড়তেন এবং প্রতি বৎসর হজ্জ সম্পাদন করতেন। তিনি তাঁর অভ্যাস মত প্রতি বছর আরাফাত ও ঈদের দিনে অদৃশ্য হয়ে যেতেন।
ইবনে বতুতাকে জালাল উদ্দিন আরও বলেছেন যে, আব্বাসি বংশের শেষ খলিফা মোতাসিম বিল্লাহকে তিনি বাগদাদে দেখেছেন। ৬৫৬ হিজরি তথা ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দে মোঙ্গর তস্কর হালাকু খানের বাগদাদ ধ্বংস এবং খলিফা মোতাসিম বিল্লাহকে হত্যাকান্ডের সময় তিনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
ইবনে বতুতা চীন হতে ভারতে ফিরে আসার পর জালাল উদ্দিনের জনৈক সহচরের সহিত তাঁর দেখা হয়। উক্ত সহচর বললেন, হজরত ১৫০ বৎসর বয়সে মানবলীলা সংবরণ করেছেন। তাঁর মৃত্যুর একদিন পূর্বে তিনি সকলকে একত্রে ডেকে বললেন, পরম করুনাময় মহান আল্লাহর ইচ্ছামতে আমি আগামীকাল তোমাদেরকে ছেড়ে চলে যাব। তোমাদের জন্য আমার পরবর্তী উত্তরাধিকারী মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন। তিনি ছাড়া আর কোন উপাস্য নাই। পরদিন জোহরের নামাজের সময় শেষ সেজদার সঙ্গে সঙ্গে তিনিও শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করে জান্নাতবাসী হন। তাঁর গোহাপার্শ্বে দাফনের জন্য কাফন ও কিছু সুগন্ধি এবং একটি কবর খোদিত অবস্থায় পাওয়া যায়। অতঃপর খানকার দরবেশগণ যথারীতি গোসল ও জানাজা সম্পন্ন করে তাঁকে সে স্থানেই দাফন করেন, আল্লাহ তাঁর আত্মার শান্তি বিধান করুন।
ইবনে বতুতা সিলেটে তিনদিন অবস্থান করেছিলেন এবং হজরত শাহজালালের আস্থানা হতে বিদায় নিয়ে তিনি নহরে আজরক তথা সুরমা-মেঘনা নদী দিয়ে নৌযানে স্বাধীন সার্বভৌম পূর্ববঙ্গ রাজ্যের রাজধানী সোনারগাঁ অভিমুখে সিলেট ত্যাগ করেন।
সূত্রগ্রন্থঃ "রিহলা" বর্ণনাকারীঃ ইবনে বতুতা লিপিকারঃ ইবনে জুজাইর
কবি, লেখক, ব্লগার, পূবালী ব্যাংকার ও হজরত শাহজালালের(রঃ) জীবনীকার ইসফাক কুরেশী
সিলেট আই নিউজ / টম
ফেসবুক পেইজ
ফেসবুক মন্তব্য