রবিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৫:১২ পূর্বাহ্ন



Repoter Image

সিলেট আই নিউজ ::

প্রকাশ ২০২২-১০-৩১ ১০:০৩:৩৮
ওরা ৬ জন। এক সিন্ডিকেটের সদস্য। টাকা কামাই করছেন দু’হাতে। কার জমি কার নামে

ওরা ৬ জন। এক সিন্ডিকেটের সদস্য। টাকা কামাই করছেন দু’হাতে। কার জমি কার নামে যাচ্ছে; সেখানে তোয়াক্কা নেই। টাকা পেলেই জমি লিখে দিচ্ছেন অন্যের নামে। বলা হয়ে থাকে; শেষ সময়ের বাণিজ্য। সিলেট সেটেলমেন্ট অফিস। এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি আলোচনায়। অভিযোগের পর অভিযোগ দিয়েও কোনো কাজ হচ্ছিল না তখন প্রকাশ্য সংবাদ সম্মেলন করে এর প্রতিকার চান কেউ কেউ। সিলেটের বিএস জরিপ শেষ।

এখন বণ্টন করা হচ্ছে প্রিন্ট পর্চা। কিন্তু বিগত কয়েক বছর ধরে জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসে ঘাপটি মেরে থাকা ওই কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নেতৃত্বে ৩০ ও ৩১ ধারা রায় পরিবর্তনসহ নানা ঘটনা ঘটানো হয়েছে। আর এখন চলছে সিলেট সিটি, সদরসহ কয়েকটি উপজেলার প্রিন্ট পর্চার প্রিন্টিংয়ের কাজ। কিন্তু এরইমধ্যে ধরা পড়েছে বড় ধরনের ঘাপলা। দেখা যাচ্ছে, অনেক ভূমির মালিকের অজান্তেই টেম্পারিংয়ের মাধ্যমে মালিকানা পরিবর্তন করা হচ্ছে। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বাংলাদেশের কোথাও সেটেলমেন্ট জোনে প্রেস নেই। কেবলমাত্র সিলেট জোনে প্রেস রয়েছে। আর এতে দুর্নীতির পথ সহজ হয়ে গেছে। সিন্ডিকেটের সদস্যরা হচ্ছেন- সিলেট জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসার মোহাম্মদ ওবায়দুর রহমান, সদর সহকারী সেটেলমেন্ট অফিসার হুমায়ূন কবির, সহকারী সেটেলমেন্টমেন্ট অফিসার মো. রহিম উল্লাহ, উপ-সহকারী সেটেলমেন্ট অফিসার গোলাম মোস্তফা লিটন, ভারপ্রাপ্ত প্রধান সহকারী আব্দুল মান্নান ও ভারপ্রাপ্ত রেকর্ড কিপার আবুল খায়ের। 

এরমধ্যে সিলেটে জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসারের চাকরির বয়স দেড় বছর হলেও হুমায়ূন কবির ১৫ বছর, রহিমউল্লাহ ১২-১৩ বছর, গোলাম মোস্তফা লিটন ১৫-১৬ বছর, আব্দুল মান্নান ২৬ বছর, আবুল খায়ের ১৫ বছর ধরে জোনাল অফিসে চাকরি করছেন। একাধারে অধিক সময় চাকরি করার সুবাদে তাদের শেকড় গভীরে। তাদের বিরুদ্ধে ভূমি মন্ত্রণালয়সহ কয়েকটি দপ্তরে অভিযোগ করেও কোনো কাজ হয়নি। মামলাও আছে কয়েকজনের বিরুদ্ধে। সিলেট শহরতলীর বড়শালা মৌজার পর্চা প্রিন্টিংয়ের জন্য জমা হয়েছে। এসএ রেকর্ডের টিলা শ্রেণি ভুয়া বিবিধ মামলা তৈরি করে শ্রেণি পরিবর্তন করা হয়েছে। একজনের নামের ৮ একর ভূমি অন্যের নামে দিয়ে দেয়া হয়েছে। ওই মৌজার প্রেসের প্রুভ কপি পরীক্ষার জন্য সহকারী জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসার ধ্রুব রঞ্জন দেব ও সার্ভেয়ার আহমদ শরীফকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। পরে তাদের তদন্তে ৮ একর ভূমির বিষয়টি ধরা পড়ার পর শুধরানোর তাগিদ দেন। এতে তাদের উপর ক্ষুব্ধ হন জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসার মো. ওবায়দুর রহমান। নিজের ক্ষমতা বলে তিনি সার্ভেয়ার আহমদ শরীফকে দোয়ারাবাজার ও ধ্রুবরঞ্জন দেবকে টাঙ্গাইলে বদলি করে দেন।

সেটেলমেন্ট কার্যালয়ে খতিয়ান টেম্পারিংয়ের আশ্রয়দাতা হিসেবে আলোচনায় রয়েছে জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসারের নাম। বাইরের দালালদের মাধ্যমে চুক্তি করে তারা মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে খতিয়ান টেম্পারিং করে দেন। সিলেট সেটেলমেন্ট অফিসার হুমায়ূন কবির-২ পরিচিত এক নাম। তিনি দু’মাস আগে অবসরে গেছেন। কিন্তু এখনো প্রতি সপ্তাহে তিনি জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসে যাতায়াত করেন। সিন্ডিকেটের সদস্য হিসেবে এখনো তিনি টেম্পারিংসহ নানা কাজে সরাসরি হস্তক্ষেপ করেন। তিনি ছিলেন ধর্মপাশা উপজেলার সহকারী সেটেলমেন্ট অফিসার। এই পদ থেকে তিনি হন সিলেট সেটেলমেন্ট জোনের কারিগরি উপদেষ্টা। প্রতিটি সেকশনে ছিল তার হাত। অবসরের পূর্ব পর্যন্ত তিনি একাধারে চূড়ান্ত প্রকাশনা, মুদ্রণ শাখা, ভলিয়ম বাধাই, রেকর্ড হস্তান্তর শাখা ও তথ্য প্রদানকারী কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেন। তার বিরুদ্ধে ভুক্তভোগী সোলেমান ফারুক বাদী হয়ে মামলা করেছেন।

মামলাটি বর্তমানে দুদকের তদন্তাধীন রয়েছে। বিভাগীয় মামলায়ও শাস্তি ভোগ করেছেন তিনি। সাবেক ভূমি সচিব মকসুদুর রহমান পাটোয়ারী তাকে ২০০০ সালে রংপুর জোনে স্ট্যান্ড রিলিজ করেন। পরে প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে মামলা করে ফিরে আসেন। গোয়াইনঘাট উপজেলার খাগড়া মৌজার ছাওর হাওর দ্বিতীয় খণ্ডের মালিকানা বদলে দেয়া হয়েছে তার হাত ধরে। এতে তিনি কয়েক কোটি টাকার বাণিজ্য করেন। সিলেট শহরতলী ছালিয়া মৌজায় একই ধরনের বাণিজ্য করেন হুমায়ূন কবির-২। সহকারী সেটেলমেন্ট অফিসার মোহাম্মদ রহিমউল্লাহ বর্তমানে হুমায়ূন কবির-২ এর বিশ্বস্ত সহযোগী হিসেবে তারই একাধিক পদে দায়িত্ব পালন করছেন।

হবিগঞ্জের সদর উপজেলার বড়চর মৌজার তদন্ত প্রতিবেদনে গেজেট প্রকাশের তথ্য গোপন করে তিনি জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসারের দুর্নীতিতে সহযোগিতা করেন। বর্তমানে একাই ৬টি শাখার দায়িত্ব পালন করছেন। সপ্তাহে লাখ লাখ টাকা অবৈধ আয় করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। সহকারী সেটেলমেন্ট অফিসার গোলাম মোস্তফা লিটন রেকর্ড পরিবর্তনের মূল কারিগর। জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসার ইউসুফ আলীর আমল থেকে তার অনিয়মের যাত্রা শুরু। ৩০ ধারার আপত্তি ও ৩১ ধারার বিশেষ অনুমোদনের জন্য জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসারের সঙ্গে আঁতাত রয়েছে তার। ভূমিখেকোদের সঙ্গে আঁতাত করে শতাধিক নিস্পত্তি হওয়া মামলা পুনরুজ্জীবিত করে দুই হাতে টাকা কামিয়েছেন তিনি। সেটেলমেন্ট অফিসার ইউসুফ আলীর সময় থেকে তিনি ৩০ ধারা ও ৩১ ধারার মৌজার বণ্টনে কর্মকর্তাদের কাছ থেকে কোটি টাকা বাণিজ্য করেন। দুর্নীতি ও অনিয়মের ঘটনায় তার বিরুদ্ধে হবিগঞ্জ আদালতে দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলা হয়েছে। তার সীমাহীন দুর্নীতির কারণে হবিগঞ্জের ওলিপুর মৌজার প্রিন্ট পর্চা বিলি করা সম্ভব হচ্ছে না।

জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসের ভারপ্রাপ্ত সহকারী আব্দুল মান্নান দুর্নীতি এখন ওপেন সিক্রেট। ২৬ বছর একই জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসে চাকরি করার সুবাদে অঢেল সম্পত্তির মালিক বনেছেন তিনি। দুর্নীতির শেষ নেই রেকর্ড কিপার আবুল খায়েরের। তার মূল পদবি যাচ মোহরার। কিন্তু তিনি ভারপ্রাপ্ত রেকর্ড কিপারের দায়িত্ব পালন করেন। জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসে পদবিধারী কয়েকজন রেকর্ড কিপার থাকলেও সিন্ডিকেটের সুবিধার্থে তাকে ওই পদে রাখা হয়েছে। এক সময় ভারপ্রাপ্ত পেশকার হিসেবে দিরাইয়ে ছিলেন। ওই সময় সহকারী সেটেলমেন্ট অফিসার ও আপত্তি অফিসার জাফর আহমদের স্বাক্ষর জাল করে দুই হাতে টাকা কামাই করেন। পরে বিতর্কিত কাজে জড়িয়ে তিনি বদলি হন। দুর্নীতির অভিযোগে বিভাগীয় মামলার নথি তিনি টাকার বিনিময়ে গায়েব করে ফেলেন। প্রায় ১০ বছর আগে সিলেট সেটেলমেন্ট অফিসে রেকর্ড কিপার ছিলেন শওকত হাসান। পরে তাকে সরিয়ে আবুল খায়ের বসেন। দুর্নীতির অভিযোগে পরবর্তীতে তাকে সরিয়ে সাধন চাকমা নামের নিয়মিত রেকর্ড কিপারকে দায়িত্ব দেয়া হলে পরে সাধন চাকমাকে সরিয়ে তিনি রেকর্ড কিপারের দায়িত্ব নেন। 

আবুল খায়ের মাঠ পর্চার কপি দিতে ভূমির মালিকদের কাছ থেকে ৫০০ টাকা, তিন সিল বিশিষ্ট মাঠ পর্চা প্রদানে ২০০০ টাকা, ৩০ ধারার জাবেদা নকল দিতে ৩০০০ টাকা, ৩১ ধারার জাবেদা নকল প্রদানে ৫০০০ টাকা নেন। কিন্তু কোনো রশিদ প্রদান করেন না। এই অনিয়ম যেন এখন সিলেট জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসে নিয়মে পরিণত হয়েছে।

অভিযোগ সম্পর্কে সিলেট জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসার মো. ওবায়দুর রহমান জানিয়েছেন, ‘আমার লোকবল কম। অভিযোগে হঠাৎ করে কাউকে সরিয়ে দেয়া সম্ভব নয়। আগে কী হয়েছে জানি না। তবে- এখন সবকিছু নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি।’

তিনি দাবি করেন, ‘অনেক অভিযোগের প্রমাণাদি থাকে না। এ কারণে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয় না। তবে, আমি কিছু কাজ শুরু করেছি। এতে আশা করি কিছু একটা হবে।’-মানবজমিন

সিলেট আই নিউজ / এসএম

ফেসবুক পেইজ