ধর্মচর্চা করতে গিয়ে সংস্কৃতিচর্চা বাদ দেবো?’

সিলেট আই ডেস্ক ::
প্রকাশিত হয়েছে : ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ৫:৪৫ পূর্বাহ্ণআরাফাত সেতু : দেশের সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংগীত ও নৃত্যের শিক্ষকের পরিবর্তে ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগের দাবিতে আগামী শুক্রবার বাদ জুমা বিক্ষোভ মিছিলের ঘোষণা দিয়েছে জাতীয় ওলামা-মাশায়েখ আইম্মা পরিষদ।
গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে তাদের এক সেমিনার থেকে এ ঘোষণা দেওয়া হয়। এতে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস ও বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের নেতারা অংশ নেন।
সেসময় নেতারা বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের এই সিদ্ধান্ত পরোক্ষভাবে নাস্তিক্যবাদী দর্শনের সঙ্গে জড়িত। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ঈমানহারা করার ষড়যন্ত্র। স্কুল শিক্ষার্থীদের ধ্বংস করার পায়তারা।
এমন পরিস্থিতিতে ‘ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার’ কোনো বিকল্প নেই উল্লেখ করে তারা বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার জাতিকে পেছনের দিকে টেনে নিতে চায়। তাদের এই সুযোগ দেওয়া হবে না। নাচ-গানের অপসংস্কৃতির মূলোৎপাটন করা হবে। প্রয়োজনে ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।
এ বিষয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মতামত জানতে চাইলে সেখানকার মুহাদ্দিস ড. ওয়ালীয়ুর রহমান খান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘প্রাইমারিতে নাচ-গান শেখানো বা এজন্য শিক্ষক নিয়োগ একটি অপ্রয়োজনীয়, অপচয়মূলক ও অযৌক্তিক পদক্ষেপ।’
তার মতে, বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা বাংলা, ইংরেজি, গণিত ও বিজ্ঞানসহ জরুরি বিষয়গুলোতে দুর্বল হওয়ার কারণে দেশে-বিদেশে সর্বত্র পিছিয়ে আছে। নিজ নিজ ধর্ম, আদব, আখলাক ও নৈতিকতা সম্পর্কে অজ্ঞ হওয়ার কারণে মিথ্যা, দুর্নীতি ও অনাচার থেকে মুক্ত হতে পারে না। সেখানে নাচ-গান শেখানোর অর্থ হলো- সেসব জরুরি বিষয়ের সময় কমিয়ে গুরুত্বহীন বিষয়ের বোঝা কোমলমতি শিশুদের মাথায় চাপিয়ে দেওয়া।
ড. ওয়ালীয়ুর রহমান খান বলেন, ‘উন্নত বিশ্ব উন্নতি করেছে সততা, নিয়মানুবর্তিতা এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চর্চা করে। আরব বিশ্ব ধনী বা উন্নত হয়েছে ধর্মীয় অনুশাসন, ন্যায়বিচার ও সম্পদের সুষ্ঠু আহরণ ও সুষম বণ্টন নিশ্চিত করে। তারা ঢালাওভাবে নাচ-গান শেখায়নি।’
বর্তমান আর্থসামাজিক বাস্তবতায় বাংলাদেশের সব স্কুলে নাচ-গান শেখানোর চিন্তাকে কোনো সচেতন ও দেশপ্রেমিক সমর্থন করতে পারে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
মিনা ম্যাগাজিন ও মুসলিম মিররসহ সৌদি আরবের একাধিক গণমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশটি তাদের ভিশন ২০৩০-কে সামনে রেখে ২০২৩ সালে কিন্ডারগার্টেনের ৭ হাজার নারী শিক্ষককে সংগীতের ওপর প্রশিক্ষণ দিয়েছে। এ ছাড়া, সরকারি সব বিদ্যালয়ে সংগীত শিক্ষা চালুর লক্ষ্যে গত বছর ৯ হাজারেরও বেশি সংগীতের শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছে। এ বিষয়ে সৌদি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা পরিচালক নূর উল দবাঘ জানান, এর মাধ্যমে শিল্প ও সংস্কৃতিকে পাঠ্যক্রমের অংশ করে শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার সাধনই সরকারের মূল লক্ষ্য।
বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক ও মিশরের জাতীয় স্কুল পাঠ্যক্রমে সংগীতকে রাখা হয়েছে।
কায়রোর এক ভাষা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গ্র্যাজুয়েট ফেলো ও এথনোমিউজিকোলজিতে পিএইচডি করা কিরা ওয়েইসের ২০২৩ সালের এক গবেষণায় উঠে এসেছে, মিশরে ১৯৩১ সাল থেকে আরব ও পাশ্চাত্য সংগীত শিক্ষাকে সরকারি বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এমনকি আরব সংগীত শিক্ষার জন্য স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান গঠনের মাধ্যমে কায়রো একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।
তুরস্কের কাস্তামোনু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংগীত শিক্ষা বিষয়ে ড. অধ্যাপক ইলহান ওজগুলের ২০০৯ সালের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৬৮ সালে সংগীত শিক্ষা তুরস্কের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে একটি আবশ্যিক বিষয় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৯৪ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংগীত শিক্ষার পাঠ্যক্রম শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক অনুমোদিত হয়। ২০০৬ সালে একটি বিশেষ কমিশনের মাধ্যমে এই পাঠ্যক্রমের সংশোধন করা হয়।
মালয়েশিয়ার সুলতান ইদ্রিস পেনডিডিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের মিউজিক ও পারফরমেন্স আর্টসের শিক্ষক মোহাম্মদ হাসান আব্দুল্লাহর ২০০৭ সালের এক গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ১৯৮২ সালে সংগীতকে প্রথমবারের মতো মালয়েশিয়ার সরকারি বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। শুরুতে এই পাঠ্যক্রম শুধু প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতেই চালু করা হয়। এরপর ১৯৯৬ সালে এটি মালয়েশিয়ার কিছু নির্বাচিত মাধ্যমিক বিদ্যালয়েও চালু করা হয়।
ইন্দোনেশিয়ার আহমদ দাহলান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাথমিক শিক্ষক শিক্ষা বিভাগের অধ্যাপক সুলারসোসহ আরও কয়েকজন শিক্ষাবিদের ২০২৩ সালের যৌথ গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশটিতে ১৯৭০ সাল থেকেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে সংগীত শিক্ষা একটি আবশ্যিক উপাদান ছিল। এ ছাড়া, ২০২১ সালের ‘নুসান্তারা ঐতিহ্যবাহী সংগীত প্রাক-কংগ্রেস’-এর পর প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যায়ে ইন্দোনেশিয়ার ঐতিহ্যবাহী সংগীত অন্তর্ভুক্ত করার প্রচেষ্টা একটি কৌশলগত পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
ইউরোপীয় কমিশনের ২০০৯ সালের এক রিপোর্ট বলছে, ইউরোপের প্রাথমিক স্কুল কারিকুলামে সংগীত একটি আবশ্যিক বিষয়। যুক্তরাজ্যে ৫ থেকে ১৪ বছর পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের জন্য সংগীত আবশ্যিক।
চীনে ৯ বছরের বাধ্যতামূলক শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রাথমিক স্কুল পর্যায়ে সংগীত একটি নির্ধারিত বিষয়। অনুরূপ সুইডেনের ৯ বছরের বাধ্যতামূলক শিক্ষা ব্যবস্থাতেও সংগীতকে গুরুত্ব সহকারে শেখানো হয়।
ইংল্যান্ড ছাড়াও জার্মানি, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকার প্রাথমিক স্কুলগুলোতে সংগীতের পাশাপাশি নৃত্যকেও আবশ্যিক বিষয় হিসেবে শেখানো হয়।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী মনে করেন, বাংলাদেশে সংগীত ও নৃত্যকলার বিরোধিতা এক ধরনের উগ্রবাদী চিন্তা-ভাবনা।
দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, ‘উগ্রবাদীদের কথা শুনে সরকার কেন পিছিয়ে যাবে। সরকার শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ, তাদের সৃজনশীলতা, উদ্ভাবনী দক্ষতার কথা ভেবে কাজ করবে। যাতে একটা সৃজনশীল জাতিগোষ্ঠী তৈরি হয়।’
তার মতে, সংস্কৃতি ও ক্রীড়াচর্চা আমাদের চিন্তা-চেতনাকে পরিশীলিত করে, মেধা ও মননের বিকাশে সহায়তা করে।
রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, ‘একদিকে দরকার সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনী দক্ষতার চর্চা, আরেকদিকে দরকার, অন্যের প্রতি শ্রদ্ধা ও অন্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা।’
‘এখন ধর্মচর্চা করতে গিয়ে কি আমরা সংস্কৃতিচর্চা বাদ দেবো। লালন শাহ, হাসন রাজা, শাহ আব্দুল করিম ও কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের, তাদের সংস্কৃতি কি আমরা বাদ দেবো?’ প্রশ্ন রাখেন তিনি।
বলেন, ‘আমি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি যে, বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ ধার্মিক কিন্তু ধর্মান্ধ নয়। সমাজে সুস্থ সংস্কৃতির চর্চা হলে মাদকের আসর বসবে না, ধর্মান্ধতার চর্চাও কমে যাবে।’
ধর্মীয় শিক্ষার সঙ্গে সংগীতের কী বিরোধ, এর কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন।
ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, ‘এই উপমহাদেশে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, বড়ে গোলাম আলী ও ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খানসহ অসংখ্য নাম বলা যাবে, যারা সংগীতচর্চা করেছেন ও ধার্মিক মানুষ ছিলেন। সংগীতের সঙ্গে গণিত ও পদার্থ বিজ্ঞানেরও সম্পর্ক আছে। অনেক বিজ্ঞানীও সংগীতচর্চা করতেন।’
তার মতে, বাংলার মানুষেরা কবিমনা, গানমনা। অশিক্ষিত মানুষ সুন্দর সুন্দর গান লিখে ফেলে, সুর করে গায়। পৃথিবীতে এমন সমৃদ্ধ সংস্কৃতি আর কোথায় আছে!
আমরা কি এখন এই সংস্কৃতি ভুলে যাবো- প্রশ্ন অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুনের।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপকের ধারণা, সরকার যদি ভয় পেয়ে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে, তাহলে এই বাংলাদেশ আর থাকবে না। দেশের মানুষ আরও খারাপ হবে। মানুষের মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ আরও বাড়বে।
আক্ষেপের সুরে বলেন, ‘তাহলে আমরা কোন কোন চর্চার দিকে যাব? সংগীতের প্রতি এই শত্রুতা কেন? এর কোনো কারণ আমার মাথায় আসে না। তারা কী চিন্তা করে, তারা কি আমাদের আদিম যুগে নিয়ে যাবে?’
ধর্মভিত্তিক দলগুলো যতই বিরোধিতা করুক, এ নিয়ে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ দেখছেন না নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক, লেখক ও গীতিকার লতিফুল ইসলাম শিবলী।
তার ভাষ্য, ‘রাস্তায়-জনসভায় কে কী বলল, এটা ইস্যু নয়। সরকার এ দেশের মানুষের আবেগ, অনুভূতি, ইতিহাস ও রাজনীতিকে আমলে নিয়েই শিক্ষানীতি প্রণয়ন করবে এবং তার শিক্ষানীতি অনুযায়ীই চলবে।’
ডেইলি স্টারকে শিবলী বলেন, ‘এটা তো কোনো ধর্মরাষ্ট্র না, এটা একটা সেক্যুলার রাষ্ট্র। সেক্যুলার রাষ্ট্রের যে চরিত্র, সেই চরিত্র অনুযায়ী এই দেশ চলবে।’
এদিকে, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংগীত শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি বাতিলের দাবি ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে উল্লেখ করেছে আইন সালিশ কেন্দ্র (আসক)।
তারা গতকাল বুধবার এক বিবৃতিতে বলেছে, সংগীত শিক্ষক নিয়োগ বাতিলের দাবি শুধু সাংবিধানিক অধিকারের পরিপন্থী নয়, বরং আমাদের জাতীয় সংস্কৃতিকে দুর্বল করার অপচেষ্টা। ডেইলি স্টার